শিশুর অধিকার রক্ষায় ইসলাম

Daily Inqilab মুফতি ইবরাহীম আল খলীল

১১ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০৫ এএম | আপডেট: ১১ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০৫ এএম

বর্তমান সময়ে পত্র-পত্রিকা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়ার দিকে তাকালে দেখা যায়, অসহনীয় মাত্রায় বেড়ে চলছে শিশু নির্যাতনসহ হত্যার মতো মারাত্মক ঘটনা। যা মহামারীর আকার ধারণ করছে। সমাজে এই ধরনের ঘৃণিত কাজ দিন দিন পাল্লা দিয়ে বেড়েই চলছে। অথচ আল্লাহ তাআলা শিশুর অধিকারের বিষয়ে তার জন্মের পূর্ব থেকেই কল্যাণমূলক ব্যবস্থা ঘোষণা করেছেন। কেননা ইসলাম পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। তাই মানুষের জাগতিক ও পরলৌকিক কল্যাণ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ইসলামের আহ্বানে সাড়া দেয়া ছাড়া বিকল্প কোনো পথ নেই। প্রাপ্ত বয়স্কদের অধিকারের স্বীকৃতির পাশাপাশি শিশুদের কল্যাণের সার্বিক দিক নির্দেশনা রয়েছে ইসলামে।
শিশুকে কোন অবস্থাতেই হত্যা করা যাবে না : শিশুদের বেঁচে থাকার অধিকার ইসলাম কর্তৃক স্বীকৃত ও সুরক্ষিত। কোনো অবস্থাতেই পিতামাতা সহ অন্য কেউ সন্তান হত্যা করতে পারে না। এমনকি চরম দরিদ্র্যতার সম্মুখীন হলেও তা করা যাবে না। আল্লাহ তায়ালা বলেন, তোমরা তোমাদের সন্তানদেরকে দারিদ্র্যের ভয়ে হত্যা করো না। তাদেরকে আমিই রিযিক দেই এবং তোমাদেরকেও। তাদেরকে (শিশুদেরকে) হত্যা করা মহাপাপ। (সুরা বনি ইসরাইল : ১৭)। যারা শিশু সন্তানদের হত্যা করে তাদের উদ্দেশ্য করে আল্লাহ বলেন, যারা নির্বুব্ধিতার দরুন অজ্ঞানবশত নিজেদের সন্তানদেরকে হত্যা করে, তারা অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। (সুরআ আনআম : ১৪০)।
শিশুর প্রতি দয়া প্রদর্শনও ইবাদাত : শিশুরা মাসুম, নিষ্পাপ। শিশুদের শারীরিক শাস্তি দেওয়া বিধেয় নয়। এমনভাবে প্রহার করা যাবে না, যাতে কেটে যায়, ফেটে যায়, ফুলে যায়, দাগ হয় বা বিবর্ণ হয়। রাগের বশীভূত হয়ে শাস্তি প্রদান করা যাবে না। শরীরের এমন কোনো জায়গায় আঘাত করা যাবে না, যাতে শারীরিক বা মানসিক ক্ষতি হতে পারে। আমাদের সমাজে শিশুরা বঞ্চনা ও নিগ্রহের শিকার হয় গৃহে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, কর্মস্থলে। কোথাও তাদের নিরাপত্তা নেই। বিদ্যালয়ে অদক্ষ, অযোগ্য, মানহীন শিক্ষক কর্তৃক অবোধ শিশুদের অমানবিকভাবে প্রহারের ঘটনা অহরহ ঘটছে। এ বিষয়ে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানপ্রধান বা পরিচালক, কর্তৃপক্ষ বা কমিটি এবং দায়িত্বশীলদের আরও সচেতন ও সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। মনে রাখতে হবে, শিশুর প্রতি দয়া প্রদর্শনও ইবাদাত।
হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, এক ব্যক্তি একটি শিশু নিয়ে বিশ্বনবীর খিদমতে এসে শিশুটিকে চুমু দিতে লাগলেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ দৃশ্য দেখে জিজ্ঞেস করলেন, শিশুটির প্রতি কি তোমার দয়া জেগে উঠেছে? সে বলল, হ্যাঁ, হে আল্লাহর রাসুল! তারপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘আল্লাহ তাআলা তোমার প্রতি এর চেয়েও অধিক দয়া করেন। কেননা তিনি দয়ালুদের শ্রেষ্ঠ দয়ালু। (বুখারি)।
শিশুদের আদর-স্নেহ করা সুন্নতে নবী : শিশুরা আল্লাহর সাজানো বাগানের ফুল। ফুল দেখলেই যেমন মানুষ তার ঘ্রাণে মোহিত হতে চায় তেমনি মানববাগানের ফুল দেখেও মানুষ আনন্দিত হয়। চক্ষু শীতল করে। শিশুরা মমতার আধার। শিশুদের আদর-স্নেহ করা সুন্নতে নবী। নবীজী ( সা.) তার দৌহিত্রকে ভরা মজলিসে স্নেহের চুম্বন দিয়ে আমাদের তা শিখিয়েছেন। একদা নবীজী (সা.) এর নাতি হাসানকে চুমু খাচ্ছিলেন, তা দেখে আকবা বিন হারেস নামে এক সাহাবি নবীজী (সা.) কে বলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ ! আপনি শিশুদের দেখে এত আনন্দিত হন এবং আদর স্নেহ করেন তারাও আপনার আদরে আপ্লুত হয় আমার তো অনেক সন্তান কিন্তু তাদের আপনার মতো স্নেহ করতে পারি না, নবীজী বলেন, তোমার হৃদয়ে স্নেহ মমতা না থাকলে আমার কী করার আছে?
হাদিসে বর্ণিত আছে, একদিন নবীজি (সা.) একদল শিশুর সঙ্গে আনন্দ করছেন। শিশুরাও নবীজী (সা.) কে ঘিরে আনন্দ খুশিতে মেতে ওঠে। এমন সময় সেখানে এক বেদুঈন এসে উপস্থিত হয়। সে নবীজী (সা.) কে বলে, শিশুদের নিয়ে এমন আমোদ আহ্লাদ করা আমার পছন্দ নয়। এ কথা শুনে নবীজী (সা.) এর হাসিমাখা মুখ মলিন হয়ে যায়। তিনি বললেন, যে ব্যক্তির হৃদয়ে মায়া দয়া নেই, আল্লাহ যেন তাকে দয়া করেন না।
সুস্থভাবে বেঁচে থাকা প্রত্যেক শিশুর মৌলিক অধিকার : মায়া, মমতা, সহানুভূতি এসব গুণ মহান আল্লাহ তায়ালাই দিয়েছেন মানুষের হৃদয়ে। তবে নানা কারণে প্রকৃতিতে যেমন বিপর্যয় দেখা দেয়, তেমনই মানুষের চিন্তা-চেতনাতেও বৈকল্য ঘটে। বিপর্যয় দেখা দেয়। বর্তমানে এমন এক বৈকল্যময় সময় অতিক্রান্ত করতে হচ্ছে আমাদের। দেশে শিশু হত্যা ও নির্যাতন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। পাঠকমাত্রই এর ভয়াবহতা সম্পর্কে কমবেশি অবগত। সংবাদ মাধ্যম গুলোর দিকে তাকালেই তা আচ কারা যায়।
সম্প্রতি সিলেটে মুনতাহা নামক এক নিষ্পাপ শিশু হত্যার যে লোমহর্ষক ঘটনার কথা শোনা যাচ্ছে; তা শুধু ভয়াবহই নয়, অমানবিক ও ব্যতিক্রমও। শিশুর প্রতি এমন নিষ্ঠুর আচরণ বনের হিংস্র জানোয়ারেরা করলে একটা কথা ছিল। মানুষ হয়ে এমন অমানুষের কাজ কী মেনে নেওয়া যায়? শিশুর নরম দেহকে যারা ক্ষত-বিক্ষত করছে তাদের বাড়িতে কি কোনো শিশু নেই? শিশুর প্রতি কারও মনে যদি ভালোবাসার উদয় না হয় তাহলে তাকে মানুষ হিসেবে গণ্য না করাই ভালো।
ইসলাম সব সময়ই শিশুরা সুস্থ এবং নিরাপদে বেচেঁ থাকার কথা বলেছে। তাদের অধিকার নিশ্চিত করেছে। সুস্থভাবে খেয়েপরে নিরাপদে বেঁচে থাকা প্রত্যেক শিশুর মৌলিক অধিকার। শিশুদের জীবন রক্ষা করার জন্য মহানবী (সা.) সর্বাগ্রে দয়ামায়াহীন আরব পৌত্তলিকদের জুলুমের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। শিশুদের যথার্থ মর্যাদায় অভিষিক্ত করে তিনি শিশুহত্যায় নিষেধাজ্ঞা জারি করে বলেন, ‘তোমরা তোমাদের সন্তানদের গোপন পন্থায় ধ্বংস করবে না।’ (আবু দাউদ)। যে জাতি আপন সন্তানকে জীবিতাবস্থায় মাটিচাপা দিয়ে আনন্দ-উল্লাস করত, ইসলামের নবীর সংস্পর্শে ও হুঁশিয়ার বাণীতে তা পরিত্যাগ করে তারাও সভ্য সমাজ হয়ে ওঠে। এভাবে তিনি কোমলমতি শিশুদের পৃথিবীতে নিরাপদে বেঁচে থাকার মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করেছেন।
শিশুর মানসিক বিকাশের জন্য রাসুলে করিম (সা.) তাদের সঙ্গে কোমল ব্যবহার নিজে করেছেন এবং অন্যদেরও সদাচার করার নির্দেশ প্রদান করেছেন। তিনি চাইতেন শিশুরা যেন কোনো সময় কষ্ট না পায় বা নির্যাতনের শিকার না হয়। শিশুদের যেকোনো মৌলিক চাহিদা মেটাতে তিনি ছিলেন অত্যন্ত যতœশীল। কোনো শিশু দুষ্টুমি করলে তিনি তাকে কড়া শাসন না করে হাসিমুখে শোধরানোর কৌশল গ্রহণ করতেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) ঘোষণা করেন, ‘যে ছোটকে স্নেহ-মমতা করে না এবং বড়কে শ্রদ্ধা করে না সে আমাদের দলভুক্ত নয়।’ (তিরমিজি : ২০৪৪)।
তাই আসুন আমরা নিষ্ঠুরতা পরিহার করে শিশুদেরকে সুন্দর মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তুলি। তাহলে ভবিষ্যৎ পৃথিবী হবে আরও সুন্দর। ইসলামের শিক্ষা সব শিশুই যেন নিরাপদে বেড়ে ওঠে। অথচ আজকের আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তির যুগেও আমাদের দেশে শিশুরা কতই না অবহেলিত, নির্যাতিত ও নির্মম হত্যাযজ্ঞের শিকার! সুতরাং ইসলামের সুমহান শিক্ষাকে সামনে রেখে যদি নীতি-নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধের আদর্শ শিক্ষা-দীক্ষায় শিশুদের যথাযথ স্নেহ-ভালোবাসা দিয়ে মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তোলা যায়, তাহলে পিতামাতা, সমাজ, জাতি ও রাষ্ট্র তাদের সেবালাভে উপকৃত হবে।


বিভাগ : ইসলামী জীবন


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

কোরআন তেলাওয়াত আমাদের হৃদয়ে প্রশান্তি দান করে: কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ

কোরআন তেলাওয়াত আমাদের হৃদয়ে প্রশান্তি দান করে: কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ

ড. ইউনূসের ৫ মামলা বাতিলের রায়ে আইনি দুর্বলতা পাননি আপিল বিভাগ

ড. ইউনূসের ৫ মামলা বাতিলের রায়ে আইনি দুর্বলতা পাননি আপিল বিভাগ

শেরপুরে জামায়াতের দিনব্যাপী শিক্ষা শিবির অনুষ্ঠিত

শেরপুরে জামায়াতের দিনব্যাপী শিক্ষা শিবির অনুষ্ঠিত

চুয়াডাঙ্গা শহরের জান্নাতুল মাওলা কবরস্থান থেকে হাত-পা মুখ বাঁধা অবস্থায় এক অচেতন সেনা সদস্য উদ্ধার

চুয়াডাঙ্গা শহরের জান্নাতুল মাওলা কবরস্থান থেকে হাত-পা মুখ বাঁধা অবস্থায় এক অচেতন সেনা সদস্য উদ্ধার

আফগানিস্তানে এবার ক্ষেপণাস্ত্র হামলা পাকিস্তানের

আফগানিস্তানে এবার ক্ষেপণাস্ত্র হামলা পাকিস্তানের

মাওলানা মামুনুল হক আমির জালালুদ্দীন মহাসচিব নির্বাচিত

মাওলানা মামুনুল হক আমির জালালুদ্দীন মহাসচিব নির্বাচিত

বসুন্ধরায় ফ্যাশন ব্রান্ড ‘হিজাবিয়ানা’র আউটলেট উদ্বোধন

বসুন্ধরায় ফ্যাশন ব্রান্ড ‘হিজাবিয়ানা’র আউটলেট উদ্বোধন

‘সরকার এতই যোগ্য যে, থানা থেকে ওসি পালিয়ে যায় কিন্তু টেরই পায় না’: মাহমুদুর রহমান মান্না

‘সরকার এতই যোগ্য যে, থানা থেকে ওসি পালিয়ে যায় কিন্তু টেরই পায় না’: মাহমুদুর রহমান মান্না

সাংবাদিকতা হতে হবে পুরো সত্য, আংশিক নয়: কাদের গনি চৌধুরী

সাংবাদিকতা হতে হবে পুরো সত্য, আংশিক নয়: কাদের গনি চৌধুরী

জিয়া পরিবারের জন্য বাংলাদেশের অস্তিত্ব টিকে আছে - যুবদল নেতা রেজাউল কবীর পল

জিয়া পরিবারের জন্য বাংলাদেশের অস্তিত্ব টিকে আছে - যুবদল নেতা রেজাউল কবীর পল

বাসভবনকে ‘দুর্গে’ পরিণত করেছেন অভিশংসিত প্রেসিডেন্ট

বাসভবনকে ‘দুর্গে’ পরিণত করেছেন অভিশংসিত প্রেসিডেন্ট

কুষ্টিয়ায় ৮ ঘন্টার ব্যবধানে দুটি সড়ক দুর্ঘটনায় ২ জন নিহত, আহত-৩

কুষ্টিয়ায় ৮ ঘন্টার ব্যবধানে দুটি সড়ক দুর্ঘটনায় ২ জন নিহত, আহত-৩

তারেক রহমানকে আমন্ত্রণ জানালেন ডোনাল্ড ট্রাম্প

তারেক রহমানকে আমন্ত্রণ জানালেন ডোনাল্ড ট্রাম্প

২০২৪ সালে সড়কে নিহত ৭ হাজারের বেশি, দায় নিলেন সড়ক উপদেষ্টা

২০২৪ সালে সড়কে নিহত ৭ হাজারের বেশি, দায় নিলেন সড়ক উপদেষ্টা

অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্যে ইরানে অস্থিরতা বাড়ছে

অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্যে ইরানে অস্থিরতা বাড়ছে

মাদারীপুরের কালকিনিতে মটরসাইকেলের ধাক্কায় কিশোর নিহত

মাদারীপুরের কালকিনিতে মটরসাইকেলের ধাক্কায় কিশোর নিহত

ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সিলেটে একটি হাসপাতাল উদ্বোধন করলেন ড. ইউনুস

ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সিলেটে একটি হাসপাতাল উদ্বোধন করলেন ড. ইউনুস

বাংলাদেশ মাঠ প্রশাসন প্রশাসনিক কর্মকর্তা কল্যাণ সমিতি টাঙ্গাইল জেলা শাখার কমিটি গঠন

বাংলাদেশ মাঠ প্রশাসন প্রশাসনিক কর্মকর্তা কল্যাণ সমিতি টাঙ্গাইল জেলা শাখার কমিটি গঠন

জানুয়ারির মধ্যেই শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেওয়া হবে : ড. বিধান রঞ্জন

জানুয়ারির মধ্যেই শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেওয়া হবে : ড. বিধান রঞ্জন

মুকসুদপুর উপজেলা প্রশাসনের হস্তক্ষেপে বিএনপির দু গ্রুপের সভা হয়নি গোটা উপজেলার পরিবেশ শান্ত

মুকসুদপুর উপজেলা প্রশাসনের হস্তক্ষেপে বিএনপির দু গ্রুপের সভা হয়নি গোটা উপজেলার পরিবেশ শান্ত